বিসিএস ব্যবচ্ছেদের মৌসুম!

মৌসুম চলছে, বিসিএস ব্যবচ্ছেদের মৌসুম! এরকম উপলক্ষ্য বছরে কয়েকবার আসে – প্রিলির আগে-পরে, বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর, আর চাকরিতে যোগদানের সময়। লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার সময় কিছুটা আমেজ পাওয়া যায়, তবে ঠিক জমে না।
এই মৌসুমগুলো আমি বেশ উপভোগ করি। বিচক্ষণ ব্যক্তিবর্গের এক অংশ বিসিএসের পক্ষে, আরেক অংশ বিপক্ষে। এটি আমাদের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে কোন ব্যাপারে দু’টি পক্ষ তৈরি হওয়া আমাদের ঐতিহ্যের অংশ, ইদানীং সেটা সংস্কৃতিতেও পরিণত হয়েছে।
সে যাই হোক, এখন বিসিএসে যোগদানের মৌসুম (পড়ুন ‘সিজন’, আরাম লাগবে) চলছে। বাংলাদেশের শিক্ষিত যুবকদের একটি বড় অংশ বিসিএসকেন্দ্রিক কেন সেটা নিয়ে কেউ শিক্ষা ব্যবস্থার উপর দায় দিচ্ছে, কেউবা আবার বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতির উপর দায় দিচ্ছে। ভাবলাম এই মৌসুমে কোন একটা দলে নাম লেখাই, বাইরে থেকে দেখার চেয়ে বেশি মজা মিললেও মিলতে পারে।
যারা কষ্ট করে এই লেখাটার উপসংহার পর্যন্ত পড়তে চাইবেন না, তাদের জন্য আগেই বলে ফেলি, বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতিতে তেমন কোন গুরুতর সমস্যা আছে বলে আমি মনে করিনা, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা বাদ দিয়ে বিসিএসের গাইড নিয়ে লাইব্রেরিতে পরে থাকে তাদেরকে আমি সমর্থন করি এবং শিক্ষা পদ্ধতিতে ব্যাপক গুণগত পরিবর্তন আনার পক্ষে আমি। এটাই সারমর্ম, বাকিটা ব্যাখ্যা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, সবাই বিসিএসমুখী কেন? খুব সাধারণ উত্তর – অর্থ, ক্ষমতা, সামাজিক স্বীকৃতি প্রভৃতি। এগুলো কে না চায়? কেউ সেগুলো বিসিএসের মাধ্যমেই অর্জনের চেষ্টা করে, কেউ হয়তো অন্য কোন পদ্ধতিতে চেষ্টা করে।
এবার দেখি, পরিসংখ্যান কি বলে? ৩৮তম বিসিএসের কথাই ধরা যাক। ৩৮তম বিসিএসে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় মোট উত্তীর্ণ ৮৩৭৭ জন। তন্মধ্যে, ক্যাডারে নিয়োগ ২২০৪ জন, নন-ক্যাডার প্রথম শ্রেণির (৯ম গ্রেড) পদে ১৭৬৩ জন, দ্বিতীয় শ্রেণির (১০ম গ্রেড) পদে ১৫২২ জন এবং দ্বিতীয় শ্রেণির (১১তম গ্রেড) পদে ২৪ জনসহ ক্যাডার , নন-ক্যাডার মিলিয়ে সর্বমোট ৫৫১৩ জনকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয় [প্রথম আলো, ২০২১; বাংলা ট্রিবিউন, ২০২২]। মোটাদাগে বললে, বিসিএসের মৌখিক ও লিখিত পরীক্ষায় পাশ করলে ৬৫-৭০% সম্ভাবনা থাকে আপনার একটা চাকরি হবে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেই, নন-ক্যাডারে চাকরিতে আবেদন করেনি অন্তত ২০০০ জন। সেটা বিবেচনায় নিলে এই শতকরা হার আরও বাড়বে।
প্রতিটা বিসিএসে কম-বেশি এরকমই নিয়োগ হয়। এটা গেল বিসিএসের হিসাব, যারা বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন ব্যাংক, এনজিও, প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অনেক নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতির মাধ্যমেই হয়ে যাচ্ছে এবং চাকরিও হচ্ছে। বিসিএসের প্রস্তুতি নিয়ে অন্য চাকরি হয়েছে এই সংখ্যা নেহাৎ মন্দ নয়। পরিসংখ্যানটা এজন্যই দিলাম, বিসিএসের ব্যাপারে যারা সিরিয়াস তাদেরকে অন্তত বেকার থাকতে হচ্ছে না। একটা রুটি-রুজির ব্যবস্থা অন্তত হচ্ছে।
আপনারা যারা প্রশ্ন তোলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা না করে সবাই লাইব্রেরিতে বসে বিসিএসের গাইড কেন পড়বে – তাদের উদ্দেশ্যে আমার পাল্টা প্রশ্ন, সারাবছর লাইব্রেরিতে বিসিএস গাইড পড়ার পর উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে বের হয় কিভাবে তারা! আবার তাদের সিজিপিএ খুব একটা মন্দ নয়!
এর অর্থ দাঁড়ায়, কোথাও একটা গলদ আছে। তাদেরকে হয় উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সাথে ইনভলভ করতে পারেনি, অথবা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরীক্ষার অন্তবর্তীকালীন সাজেশননির্ভর পড়েই পরীক্ষায় পাশ করা যায় এবং ভালো ফলাফল অর্জন করা যায়।
এতো গেল, যারা বিসিএস প্রস্তুতি এবং উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা একসাথে করছে তাদের কথা। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে সিরিয়াস, বিসিএসের গাইড কখনও খুলে দেখেনি তাদের ব্যাপারে বলি। ধরুন একজন শিক্ষার্থী কোন একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিলোসোফিতে (ফিলোসোফি শুধুই একটা উদাহরণ, অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রেও কম-বেশি কথাগুলো প্রযোজ্য) মাস্টার্স করেছে। পড়াশোনায় ব্যাপক সিরিয়াস, কখনো রাজনীতি করেনি, কোন বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আনুগত্য কখনো স্বীকার করেনি, বিসিএসকেন্দ্রিক কোন চাকরির কোন প্রস্তুতি সে নেয়নি। সে যখন পাশ করে বের হবে, বাংলাদেশের কোন চাকরিটার জন্য সে উপযুক্ত বলতে পারবেন? মানলাম বাংলাদেশে চাকরির অপ্রতুলতা আছে। বাংলাদেশের বাইরে গ্লোবাল জব মার্কেটে কোন জবটার জন্য সে উপযুক্ত বলতে পারবেন? আচ্ছা বিষয় ফিলোসোফি পরিবর্তন করে বাংলা, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, ইতিহাস, ইংরেজি, ভূগোল যেটাই করুন না, দৃশ্যপট কি খুব একটা পাল্টাবে?
এই দায়টা কার? একটু চিন্তা করলেই এর উত্তর পাওয়া যাবে। এই শিক্ষার্থীরা তাদের সমগ্র চাকুরি জীবনে কতবার ক্যারিয়ার কনসালট্যান্সি পেয়েছে? কতটি জব ফেয়ার পেয়েছে? সিভি কিভাবে বানাতে হয়, কাভার লেটার কিভাবে লিখবে কখনো শেখানো হয়েছে? কতবার সে আধুনিক জব মার্কেট সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে? সাবজেক্ট নলেজের পাশাপাশি আর কী কী কোয়ালিটি সে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ডেভেলপ করেছে? তার এনালাইটিক্যাল এবিলিটির কতটুকু বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে অর্জন হয়েছে? পাবলিক স্পিকিং, প্রেজেন্টেশন স্কিলস, কম্পিউটার দক্ষতা, নেগোসিয়েশনের দক্ষতা, বিশেষ কোন টুলস বা সফটওয়্যার ব্যাবহারে পারদর্শিতার কতটুকু সে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জন করেছে বলতে পারবেন?এলামনাইদেরই বা ভূমিকা কী? তাদের সাথে তরুণ শিক্ষার্থীদের কতটুকু যোগসূত্র আপনারা তৈরি করে দিতে পেরেছেন? সব বাদ দিলাম, কোন একটি বিশেষ বিষয়ে অনার্স বা মাস্টার্স করে তার কী কী স্কোপ আছে তাওতো সে বলতে পারবে বলে মনে হয়না।
যেখানে আমরা শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টিতে ব্যর্থ হচ্ছি, যেখানে আমরা তাদেরকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারছি না, যেখানে পরীক্ষার আগের রাতে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফলাফল করা যায়, সেখানে দায়টা বিসিএসের উপর এবং বিসিএসের পরীক্ষা পদ্ধতির উপর দেয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত – আপনাদের প্রতি পাল্টা প্রশ্ন রইলো।
একটা উদাহরণ দেই, সরকারের বদান্যতায় একটা বৈদেশিক মাস্টার্স করার সুযোগ হয়েছে। পুরোপুরি পেপারবেজড একটা সাবজেক্ট। সাইটেশন, রেফারেন্সিং খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটা পেপারের জন্য। এক লাইন কপি হলেই টার্নিটিন-এ ধরা । প্রথমবারের মতো মনে হলো, “I am a fish, out of the water.” এন্ডনোট, ম্যান্ডেলে, জোটেরোর মতো Reference Management Software এর ব্যবহার এই বয়সে নতুন করে শিখতে হলো, এর পর আবার এপিএ, হাভার্ড কত স্টাইল! খালি আমার যে এই অবস্থা হয়েছে তা নয়, বাংলাদেশ থেকে আমরা যারা গেছি সবারই কম-বেশি একই অবস্থা। ২২/২৩/২৪ বছর বয়সী ইন্ডিয়ানদের দেখে মনে হতো তারা যেন মায়ের পেট থেকেই এসব শিখে এসেছে, যার যা’ই ব্যাকগ্রাউন্ড থাকুক না কেন এসব তাদের নখদর্পনে!
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বন্ধু-বান্ধবদের অনেককেই দেখেছি আরেক জায়গা থেকে Reference/Bibliography কপি করে এনে বসিয়ে দিচ্ছে। এসাইনমেন্ট এর সাথে সম্পর্ক থাকুক বা না-থাকুক, রেফারেন্স দেওয়াটাই আসল! তাদের ফলাফল কখনো খারাপ হয়েছে শুনিনি! রেফারেন্স কপি করেও দেয়া যায়! কী আজব না!
যারা বিসিএস প্রস্তুতি নিয়েছে বা নিচ্ছে, বিসিএস পরীক্ষায় পাশের মাধ্যমে বর্তমানে চাকুরিতে নিয়োজিত আছে তাদের জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলেন, সেসব প্রশ্নকর্তাদের জ্ঞানের গভীরতা নিয়ে আমি সন্দিহান। কারণ হয় তারা বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে জানেন না, অথবা, কখনো প্রিলির বাইরে অন্য কোন চিন্তা করেননি। অথবা অনেক চেষ্টা করেও ক্যাডার/নন-ক্যাডার হতে পারেননি৷ যারা লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাশ করে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, তারা গণিতে দক্ষ, তারা ইংরেজি-বাংলায় ফ্রি-হ্যান্ডে লিখতে পারে, অভ্যন্তরীণ/আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, ভূগোল সম্পর্কে তাদের ভালো একটা ধারণা থাকে, তাদেরকে লিটারেচার জানতে হয় এবং পড়তে হয়, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে ধারণা থাকতে হয়, এনালাইটিক্যাল এবিলিটি তাদের ভালো, সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তাদের ধারণা থাকতে হয়। একজন সিভিল সার্ভেন্টের (নন-টেকনিক্যাল) আর কী কী জ্ঞান থাকা উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?
আপনারা সরকারের উপর দায় বর্তাতে চান, সরকার জব ফিল্ড তৈরি করতে পারেনি! ধরে নিলাম, সরকার অনেকগুলো ফিল্ড তৈরি করে দিল। আমাদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যারা বের হচ্ছে তারা কী সেসব ফিল্ডে কাজ করার উপযুক্ত হচ্ছে? দেশীয় কোম্পানিগুলোকে ট্যাকনিক্যাল-ননট্যাকনিক্যাল বেশিরভাগ টপ-লেভেলের লোকবল শ্রীলংকা, ইন্ডিয়া তথা বিদেশ থেকে রিক্রুট করতে হচ্ছে, কেন? এই দায় কার? আর জব ফিল্ড তৈরি করার দায়িত্ব সরকারের না প্রাইভেট সেক্টরের, প্রাইভেট সেক্টর কেন বুম করছে না বা সেটার দায় কার এটা নিয়ে পরে আরেকবার লিখবো।
বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতি পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত আমি বলবো না। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, সিভিল সার্ভেন্টদের নিয়োগ পরীক্ষায় আবশ্যিকভাবে কম্পিউটার দক্ষতা, প্রেজেন্টেশন দক্ষতা, পাবলিক স্পিকিং এর মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ। অবশ্যই বিসিএসের আবেদনের সাথে কাভার লেটারসহ একটা একটা সিভি সাবমিট করা বাধ্যবাধকতা রাখা উচিৎ এবং সেটার উপর একটা ওয়েটেজ রাখা উচিৎ, এক্সট্রাকারিকুলার এক্টিভিটিস এর উপর ওয়েটেজ রাখা উচিৎ। তাতে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসব শেখানো না হলেও শিক্ষার্থীরা অন্তত নিজ তাগিদে বিষয়গুলো শিখে নিবে।
সবাই জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা খোঁজে। মানুষ উদ্যোক্তা হওয়ার কথা বলে। বিসিএস প্রস্তুতিতে যে শ্রম দেয়া হয় সেরূপ শ্রম উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে দিলে আমি বিশ্বাস করি অনেকেই হয়তো একজন বিসিএস ক্যাডারের চেয়ে ভালো জীবন পেত, সেটা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু এখানে রিস্কটাও কম নয়। এক্ষত্রে ব্যর্থতার গল্প একেবারে কম নয়। সবাই জীবন নিয়ে এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও রাজী নয়। কারো বিসিএস প্রস্তুতির মাধ্যমেই যদি একটা জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা হয়, সেটা নিয়ে এত বিষেদাগারের কিছু আমি দেখিনা।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান, এদেশের প্রত্যেক মানুষকে জীবিকার স্বাধীনতা দিয়েছে। মানুষ সেটাই গ্রহণ করবে, যেটা তার কাছে ঝুঁকিমুক্ত মনে হয়, যেটা বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়। সর্বোপরি, যে সুযোগগুলো তার জন্য উন্মুক্ত মানুষ সেখান থেকে নির্বাচন করার চেষ্টা করবে – এটাই স্বাভাবিক। প্রথমে আপনি তাদেরকে অপশনগুলো শেখান, তারপর সেগুলোর জন্য প্রস্তুত করুন, তারপর নাহয় সময় পেলে একটু বিসিএসের সমালোচনা করলেন। তাহলে পরের বিসিএস মৌসুমে আপনার কথার জবাব দেয়ার জন্য আমার মত দর্শক সারির মানুষ লেখাজোখা করবে না।
লেখক- রোমেন শর্মা,উপজেলা নির্বাহী অফিসার।।