মুঘল আমলের পুরাকীর্তি ঐতিহাসিক বিবিচিনি শাহী মসজিদ

মিজানুর রহমান ডব্লিউ, বেতাগী (বরগুনা) প্রতিনিধিঃ
দেশজুড়ে কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে হাজারো ঐতিহাসিক স্থাপনা। মুঘল আমলের যে কয়টি পুরাকীর্তির নিদর্শন দেখা যায় বাংলাদেশে তারমধ্যে অন্যতম বিবিচিনি শাহী মসজিদ। বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বিবিচিনি ইউনিয়নে অবস্থিত প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের পুরনো এই স্থাপত্যের আয়তন খুব বিশাল না হলেও স্থাপত্য রীতিতে মুঘল ভাবধারার ছাপ স্পষ্ট প্রতীয়মান। দক্ষিণ বাংলার ইসলাম প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে অভিহিত এই মসজিদ নিয়ে প্রচলিত রয়েছে অনেক অলৌকিক কাহিনি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে শাহ নেয়ামতুল্লাহ নামে এক সাধক পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে দিল্লিতে আসেন। ওই সময় সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র ও বাংলার সুবাদার শাহ সুজা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইসলাম প্রচারের জন্য বজরায় চড়ে গঙ্গা নদী অতিক্রম করে বিষখালী নদীতে (তৎকালীন চন্দ্রদ্বীপে) শিষ্যদের নিয়ে নোঙর করেন শাহ নেয়ামতুল্লাহ। তখন শাহ সুজার অনুরোধে ওই গ্রামে এক গম্বুজবিশিষ্ট শাহী মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে সাধক নেয়ামতুল্লাহ শাহের কন্যা চিনিবিবি ও ইছাবিবির নামের সঙ্গে মিলিয়ে ওই গ্রামের নামকরণ করা হয় বিবিচিনি এবং মসজিদটির নাম রাখা হয় ‘বিবিচিনি শাহী মসজিদ’।
মসজিদ এলাকায় পা রাখতেই দূর থেকে ছোট্ট টিলার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটির একমাত্র গম্বুজটিতে চোখে পড়ে।
দিগন্তজোড়া সবুজের মাঝখানে ৩০ ফুট উঁচু টিলার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বিবিচিনি শাহী মসজিদের ভবনটি প্রায় ২৫ ফুট উঁচু। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট, প্রস্থ ৩৩ ফুট, দেয়ালগুলো ৬ ফুট চওড়া। দক্ষিণ ও উত্তরে তিনটি দরজা রয়েছে। তবে মসজিদটিতে মূল প্রবেশদ্বার একটি। মসজিদের ধূসর বর্ণের ইটগুলো মোগল আমলের ইটের মাপের সমান। দর্শনার্থী ও নামাজিদের ওঠানামার জন্য মসজিদের পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে রয়েছে দুটি সিঁড়ি। মসজিদের পাশেই রয়েছে ৩টি ভিন্নধর্মী কবর। কবরগুলো সাধারণ কবরের মতো হলেও লম্বায় ১৪-১৫ হাত। মসজিদের পশ্চিম ও উত্তর পাশে অবস্থিত কবরে শায়িত আছেন সাধক নেয়ামতুল্লাহ এবং তাঁর দুই মেয়ে চিনিবিবি ও ইছাবিবি।
স্থানীয়ভাবে মসজিদটি নিয়ে প্রচলিত আছে নানা কাহিনী। বলা হয়ে থাকে, শাহ নেয়ামতুল্লাহর দ্বীনি প্রচারে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন বহু হিন্দু ও বৌদ্ধ। স্থানীয় লোকমুখে প্রচলিত আছে ওই সময় বিষখালী নদীর পানি ছিল লবণাক্ত। সুপেয় পানির অভাবে মানুষের কষ্ট দেখে শাহ নেয়ামতুল্লাহ নিজের তসবিহ বিষখালী নদীতে ভিজিয়ে দেন। এরপর থেকেই নদীর পানির লবনাক্ততা দূর হয়। তাছাড়া সে যুগে সুন্দরবন সংলগ্ন এই অঞ্চলের নদীগুলোতে অসংখ্য কুমির ছিল। কিন্তু একই কারণে বিষখালী নদীতে কুমির আসত না বলেও প্রচলিত আছে।
দর্শনীয় এই মসজিদে অগণিত নারী পুরুষ তাদের নেক মকসুদ পূর্ণতা লাভের উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করেন। এছাড়া টাকা পয়সা ও অন্যান্য মানতের মালামাল রেখে যান মসজিদ প্রান্তে। প্রতি সপ্তাহে অসংখ্য মানুষ এসে ইবাদত করে। যে যেই আশা নিয়ে এখানে আসে তার অধিকাংশই পূর্ণ হয় বলে শোনা যায়।
প্রসাদের মতো অপরূপ কারুকাজ মণ্ডিত মসজিদটি মুঘল স্থাপত্যের গৌরব, মর্যাদা ও ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে শুধু দেশেই নয়, বাংলাদেশের বাইরে এমনকি ইতিহাসখ্যাত ব্রিটেন জাদুঘরেও এ স্থাপত্যটি সম্পর্কে নিদর্শন পাওয়া গেছে বলে জানা যায়। ১৯৯২ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের দায়িত্ব নেয় এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনের তালিকাভুক্ত করে। ঐতিহাসিক এই মসজিদটির সরকারিভাবে সংরক্ষণের দাবি এলাকাবাসীর।