পঞ্চগড়ে স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরী করা হলো দেড় কিলেমিটার কাঁচা সড়ক

সামসউদ্দীন চৌধুরী কালাম, পঞ্চগড় প্রতিনিধি-
পঞ্চগড় সদর উপজেলার গরিনাবাড়ি ইউনিয়নের ডাঙ্গাবাড়ী-মোল্লাপাড়া সড়ক। প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটি দিয়ে চলাচল করে ১৫ গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ। এক সময় এই সড়কটি দৃশ্যমান থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় সড়কটি পার্শে¦র জমির সাথে মিলিয়ে যায়। দুর থেকে সেখানে আর সড়ক দেখাই যায় না। ওই এলাকার মানুষরা কিছুদিন আগে স্বেচ্ছায় সড়কটি নির্মাণ করে। দিনের বেলা সবাই ব্যস্ত থাকায় সন্ধ্যা থেকে অনেক রাত অবধি প্রায় দুই মাস পরিশ্রম করে সড়কটি পুনরায় মাটি দিয়ে ভরাট করে তারা। পুরো এলাকাটি ‘খাড়ি’ (মাঠের মধ্যে নিচু এলাকা। যে এলাকা দিয়ে বর্ষায় পানি দিয়ে নদীতে পড়ে) হওয়ায় বর্ষাকালে পানি চলে যাওয়ার জন্য ফাঁকা রেখেছেন তারা। এখানে প্রয়োজন একটি ব্রীজ বা কার্লভার্টের। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্বাষ পাওয়া গেলেও আগামী বর্ষার আগে এখানে ব্রীজ বা কার্লভার্ট না পাওয়ার শংকা তাদের। এতে এত কষ্ট করে সড়ক বানালেও বর্ষা মৌসূমে আগের মত আরও ৪/৫ কিলোমিটার রাস্তা ঘুরে তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে হবে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পঞ্চগড় জেলা সদর হতে গাড়িনাবাড়ি ইউনিয়নের ডাঙ্গাবাড়ি থেকে মোল্লাপাড়া যাওয়ার জন্য ব্রিটিশ আমল থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার একটি সরু রাস্তা ছিল। তবে সড়কটি কোনো দিন সংস্কার না হওয়ায় তা ফসলি জমিতে মিশে গেছে। চিহ্ন হিসেবে ছিল একটি আলপথ। এই আলপথ দিয়েই পশ্চিমের মোল্লাপাড়া, দরদরিয়াপাড়া, গাড়িয়ানপাড়া, মিস্ত্রীপাড়া, বোদাপাড়া, বজরাপাড়া, কালুপাঠা, পাটশিড়ি, শিংপাড়া ও কালিখাপাড়া এবং পূর্বের ডাঙ্গাবাড়ী, শেখপাড়া, যতনপুকুরী, মরিচপাড়া, মীরগড়সহ আরো কয়েকটি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ চলাচল করত। শুষ্ক মৌসুমের সেই আলপথ ধরে চলাচল করতে পারলেও বর্ষাকালে তাদের সেই পথে যাওয়ার কোনো উপায় থাকে না। কখনো কলাগাছের ভেলা তৈরি করে, আবার কখনো হাঁটুপানিতে মাড়িয়ে যেতে হয় গন্তব্যে। জেলা শহরে যাতায়াতে বা অন্য কোনো গন্তব্যে যেতে প্রায় তিন থেকে চার কিলোমিটার পথ ঘুরে চলাচল করতে হতো।
সড়কটি সংস্কার বা নতুন করে তৈরির জন্য বিভিন্ন দপ্তরে একাধিকবার ঘুরেও কোনো সমাধান পাননি এলাকাবাসীরা। অবশেষে নিজেদের ভোগান্তি নিরসনে উদ্যোগ নেন মোল্লাপাড়া এলাকার বাসিন্দারা। গত ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে সিদ্ধান্ত নেন নিজেরা মাটি কেটেই বানাবেন সড়ক। গ্রামের সব শ্রেণিপেশার মানুষ প্রতিদিন সন্ধ্যার পর জড়ো হন সড়ক নির্মাণের সেই স্থানে। প্রতিদিন রাত আটটার পর শুরু হয় তাদের মাটি কেটে সড়ক তৈরির কাজ। এতে অংশ নিতেন প্রামের কিশোর, তরুণ, যুবক ও বয়স্করা মিলে প্রায় ১০০ জন। গ্রামবাসীর মধ্যে কেউ চাল, কেউ ডাল, কেউ আলুসহ বিভিন্ন উপকণের খরচ দিতেন। মাঝেমধ্যেই রান্না করা হতো খিচুড়ি। সাউন্ড বক্সে বাজানো হতো গান। আনন্দের সঙ্গে তারা কাজ করেন। গানের তালে তালে কেউ কোদালের কোপে মাটি কাটতেন আবার কেউ ডালিতে নিয়ে মাটি ফেলতেন জমির আলে। এভাবেই দুই মাসে মাসে প্রায় দেড় কিলোমিটার সড়ক তৈরির বেশির ভাগ কাজই সম্পন্ন করেছেন তারা। এখন বর্ষায় পানি চলাচলের জন্য জরুরী প্রয়োজন একটি ব্রীজ বা কার্লভার্ট। এ নিয়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগও করেছেন তারা। এ নিয়ে আশ্বাষও দিয়েছেন তারা। কিন্তু এখানে ব্রীজ বা কার্লভার্ট কবে হবে এ নিয়ে কোন নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না তারা।
মোল্লাপাড়া এলাকার বাসিন্দা মাহবুব ও সেলিম জানান, দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে কোন কাজ না হওয়ায় নিজেরাই রাস্তা তৈরীর সিদ্ধান্ত নেই। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকলে মিলে রাতের বেলা আমরা রাস্তা বানাই। কারণ এই রাস্তাটা আমাদের খুব প্রয়োজন। দুই পাশের অনেক গ্রামের মানুষ এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করে। সড়কের পূর্ব অংশে রয়েছে একটি গোরস্তান। পশ্চিমের কয়েকটি গ্রামের মানুষ কেউ মৃত্যুবরণ করলে এই গোরস্তানেই কবর দেয়।
মোল্লাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সলিমুল্লাহ বলেন, এলাকাবাসীর মিলে নতুন করে রাস্তা তৈরী করেছি। এখন প্রয়োজন একটি ব্রীজ বা কার্লভার্টের। জেলা প্রশাসক মহোদয় আমাদের আশ্বাষ দিয়েছেন। ইউএনও ও পিআইও মহোদয়গণ আমাদের রাস্তাটি দেখে গেছেন। সবাই বলেছেন এখানে একটি ব্রীজ বা কার্লভার্টের প্রয়োজন। তবে কতদিনে এখানে ব্রীজ বা কার্লভার্ট নির্মাণ করা হবে এটা কেউ নিশ্চিত করে বলেননি।
গরিনাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন দীপু বলেন, সেখানে সড়ক বানাতে আমিও তাদের উৎসাহ দিয়ে সাধ্যমত তাদের সাথে শরিক হওয়ার চেষ্টা করেছি। রাস্তা ও ব্রীজের বিষয়টি আমি উপজেলা পরিষদের সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে যোগাযোগ করেছি। বর্ষায় যেন নতুন তৈরী করা রাস্তাটি ভেঙ্গে না যায় সে কারণে এলজিএসপি প্রকল্পের আওতায় সড়কের উত্তর পাশে গাইড ওয়াল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। আগামী বর্ষায় মানুষজন ও ছোট যানবাহন চলাচলের জন্য সেখানে একটি বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করা হবে। সেখানে কালভার্ট নির্মাণের জন্য উপজেলা পরিষদের সমন্বয় সভায় উত্থাপন করেছি।
পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, ওই সড়ক নির্মাণের বিষয়ে এর আগে কেউ তেমনভাবে জানায়নি। গ্রামবাসী নিজেরা মিলে রাতে মাটি কেটে এমন সড়ক নির্মাণ করায় তাঁদের সাধুবাদ জানাই। বিষয়টি জেনে ইতিমধ্যে আমাদের সদর উপজেলার এসি ল্যান্ড ওই সড়ক পরিদর্শন করেছেন। সেই সঙ্গে ওই সড়কে একটি কালভার্ট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। #