# Tags

ফুলবাড়ীতে স্কুল শিক্ষক, সম্মাননার অর্থ দিয়ে গড়ে তুলেছেন “বঙ্গভাষা”লেখক জাদুঘর

উত্তম কুমার মোহন্ত, ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) থেকে:

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক কবিদের বই,পুরোনো ম্যাগাজিন ও অতি দুর্লভ পত্র-পত্রিকা সহ সংরক্ষণ করা হয়েছে বিভিন্ন কবি ও লেখকদের ছবি সহ জীবনী, আরও রয়েছে সাহিত্যিকদের লেখা দুর্লভ চিঠি সংগ্রহ করে ১০ শতাংশ জমির উপরে গড়ে তুলেছেন “বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর”।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের উত্তর বড়ভিটা গ্রামে এ সংগ্রহশালা তৈরি করেছেন স্কুল শিক্ষক তৌহিদ -উল ইসলাম (৫৭)। দীর্ঘদিন থেকে পাশের জেলা লালমনিরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিষ্ঠার সাথে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ২০২২ সালে আইপি ডিসি প্রথম আলো প্রিয় শিক্ষক সম্মাননায় সেরা শিক্ষক হিসেবে দুই লক্ষ টাকা পান পরবর্তীতে ব্যাক্তিগত এক দেড় লাখ টাকা সাথে যোগ করে আর দেরি করলেন না তৌহিদ -উল ইসলাম শুরু করেন তার স্বপ্নের জাদুঘর নির্মাণের কাজ। বাড়ির পাশে আধাপাকা টিন শেড ঘর নির্মাণ করে সেটাই এখন জাদুঘর।

শিক্ষক তৌহিদ -উল ইসলাম নিজ অর্থায়নে ২০১১ সালে গীতিকার তৌহিদ-উল ইসলাম পাঠাগার ও ২০২১ সালে সৈয়দ শামসুল হক কালচারাল ক্লাব ও সাংস্কৃতিক মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। পাঠাগার টিতে ছয় হাজার বই সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা রয়েছে। এদিকে শিশু সাহিত্যের বিকাশের জন্য নিজ অর্থায়নে ২০২১ সালে চালু করেছেন শিশু সাহিত্যে পুরস্কার। বার্ষিক এই পুরুস্কারের অর্থ মুল্যে বিশ হাজার টাকা। শিশুদের বই পড়তে আগ্রহী করার জন্য কৌশল হিসেবে খাতা কলম ও চকলেট উপহার দিয়ে থাকেন। এছাড়াও পাঠাগার ও কালচারাল ক্লাবের পক্ষে দিয়ে আসছেন গুনি মানুষের সম্বর্ধনা। বঙ্গভাষা জাদুঘর,কালচারাল ক্লাব ও পাঠাগারের জন্য মোট ১৮ শতাংশ জমি তিনি দান করেছেন।

বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘরটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় জাদুঘর। ২০২৩ সালে ২৭ ডিসেম্বর মাসে কথা সাহিত্যিক সৈয়দ আনোয়ারা হক প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এ জাদুঘর টি উদ্ধোধন করেন। বাংলাদেশ প্রথম জাদুঘর চালু হয়েছে ২০১১ সালে বাংলা একাডেমীর বর্ধমান হাউসে। ফুলবাড়ীর একদম গ্রামেই গড়ে তোলা এই দ্বিতীয় জাদুঘরটি তে পাঁচটি গ্যালারি জুরে রয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দুই শতাধিক প্রয়াত কবি ও লেখকদের তথ্য সম্বলিত ছবি। এখানে রয়েছে বাংলা সাহিত্যে ও চলচ্চিত্র সংক্রান্ত পুরোনো পত্র-পত্রিকা।এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে মোহাম্মদ আকরাম “খাঁ” সম্পাদিত ১৯৩৬ সালের মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকা, কালীশ মুখোপাধ্যায়ের ১৯৪৫ সালের রুপ মঞ্চ এবং শ্রী দীলিপ সেন গুপ্ত সম্পাদিত ১৯৫৫ সালের সচিত্র ভারতী পত্রিকা। সিনেমার পত্রিকা রয়েছে অনেক ১৯৬০ সালে মার্চ সংখ্যা মাসিক মৃদঙ্গ। ক্ষিতীশ সরকার সম্পাদিত ১৯৬১ সালের জলসা পত্রিকা, আবু জাফর সম্পাদিত ১৯৬৩ সালের সন্দেশ এবং গাজী সাহাবুদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ১৯৬৮ সালে সচিত্র সন্ধানী। ১৯৫৯ সালের সাপ্তাহিক পাকিস্তানি খবর,আছে একই সালের পাক সমাচার। ধর্মীয় পত্রিকা মাসিক নেয়ামত এবং ১৯৬১ সালের সমকাল,১৯৬৬ সালের পূবালী পত্রিকা সহ বেগম পত্রিকার বেশ কিছু সংখ্যা আছে এখানে। আছে ১৯৬৮ সালের বিমল মিত্র সম্পাদিত কালি ও কলম পত্রিকা। ১৯৬৮ সালের রবীন্দ্র ভারতী ও ১৯৬৯ সালের বিশ্ব ভারতী পত্রিকা এবং ১৯৭০ সালের কবীর চৌধুরী সম্পাদিত বাংলা একাডেমী পত্রিকা সংরক্ষণ করা হয়েছে এ জাদুঘরে।রেডিও পাকিস্তানের পাক্ষিক পত্রিকা ‘এলান’ রয়েছে এখানে ১৯৫১ সালে প্রকাশিত ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ রচিত সপ্তম ও অষ্টম শ্রেনীর ব্যাকরণ পরিচয়।সুবল চন্দ্র মিত্র সম্পাদিত ১০০ বছরের পুরনো সরল বাংলা অভিধান, এছাড়াও আছে ১০০ বছর আগের কিছু প্রকাশিত বই। এখানে রয়েছে ১৪০বছর আগের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত পত্রিকা বঙ্গদর্শন,১১০ বছর আগের প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজ পত্র। এ জাদুঘরে রয়েছে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাপ্তাহিক হক-কথা, আছে ১৯৬৫-১৯৭২ সালের বেশকিছু দৈনিক পত্রিকা।

সংগ্রহশালা বা জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা তৌহিদ -উল ইসলাম দুই সন্তানের জনক তার এক ছেলে পড়াশুনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগে এক মেয়ে একাদশ শ্রেণীতে পড়ে। তিনি একাধারে শিক্ষক, শিশু সাহিত্যিক গীতিকার ও সংগঠক ও বটে। ইতি মধ্যে তিনি ভাওয়াইয়া ও আধুনিক গান লিখে বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভির তালিকাভুক্ত গীতিকারদের মধ্যে স্থান পেয়েছেন। অনেক গুণে গুণান্বিত এই স্কুল শিক্ষক আরও একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন ভবিষ্যতে পরিবেশ সুরক্ষায় ব্যাক্তি মালিকানার বড় বড় গাছ রক্ষার্থে নিজের অর্থে প্রবর্তন করেছেন বৃক্ষ ভাতার কর্মসূচির। ইতিমধ্যেই জেলার ফুলবাড়ী ও রাজারহাট উপজেলায় একর্মসূচি চালু করতে সক্ষম হয়েছেন।

তৌহিদ-উল ইসলামের স্ত্রী বেগম আমিনা সুলতানা সকালের সময়কে জানান, জাদুঘর পাঠাগার ও কালচারাল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করতে জমি বিক্রি করতে হয়েছে। প্রথম দিকে স্বামীর এইসব কাজ পাগলামি বলে মনে হয়েছিল। এখন মনে করি আমার স্বামী সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্ববান। সামাজিক কাজ করতে গিয়ে তিনি মাঝে মাঝে পরিবারের কথাই ভুলে যান। আমরা একসময় পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো কিন্তূ আমার স্বামীর কাজ আমাদের কে বাঁচিয়ে রাখবে।

পাঠাগারে নিয়মিত বই পড়তে আসা স্কুল শিক্ষার্থী একাদশী রানী বলেন, এখানে বই পড়তে আসলে খাতা- কলম ও চকলেট উপহার এলাকার অনেক শিক্ষার্থী পাঠাগারে বই পড়ে সমৃদ্ধ হচ্ছি। আমরা এখান থেকে বই পড়ার জন্য বাড়িতে নিয়ে যাই,পড়া শেষে আবার পাঠাগারে ফেরত দেই।

“বঙ্গভাষা লেখক জাদুঘর”, পাঠাগার ও কালচারাল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা স্কুল শিক্ষক তৌহিদ-উল ইসলাম বলেন, ব্যাক্তিগত উপার্জনের টাকা আমি এসবের পিছনে ব্যয় করেছি। দূর্লভ লেখা
ও পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করতে টাকা খরচ করতে হয়েছে,তাতে আমি বিন্দু পরিমাণ সংকিত নই। তবে যদি কোন সরকারি -বেসরকারি সহযোগিতা পাই তাহলে এটিকে দ্বিতল ভবন করার ইচ্ছা আছে। তিনি আরও বলেন ৬ বছর পর আমি চাকুরীতে অবসরে যাবো অবসরের ভাতায় জাদুঘরের সংগ্রহ শালা আরও সমৃদ্ধ করবে। আমার গড়ে তোলা জাদুঘর পাঠাগার ও কালচারাল ক্লাব ভবিষ্যত জাতি গঠনের ভূমিকা রাখবে এটাই হবে আমার আত্মতৃপ্তি ও পরম শান্তি।