কুলিয়ারচরে জনবল সংকটে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত

মুহাম্মদ কাইসার হামিদ, কুলিয়ারচর (কিশোরগঞ্জ):
বিগত ২০১৮সালের ৬ জুন ৩১ শয্যা থেকে উন্নীত হয়ে ৫০শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের প্রশাসনিক অনুমোদনসহ প্রতিদিন ৫০জন ভর্তি রোগীর খাবারের অনুমোদন হলেও প্রয়োজনীয় জনবল অনুমোদন না হওয়ায় এখনো ৩১শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের জনবল দিয়ে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। এতেও চিকিৎসক সংকটের সঙ্গে রয়েছে নার্সসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সংকট।
৫০ শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ছাড়াও মোট ১৪জন কনসালটেন্ট চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ২ জন। এদের মধ্যে ১জন গাইনী কনসালটেন্ট ও ১জন এ্যানেস্থেসিয়া। অন্যান্য ১২টি বিভাগের কোন কনসালটেন্ট চিকিৎসক এখানে নেই। ডেন্টাল সার্জন ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার ছাড়াও মোট ১৯ জন মেডিকেল অফিসার থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ৩ জন। বাকি ১৬জনই নেই। ইমারজেন্সি মেডিকেল অফিসার ৪ থাকার কথা থাকলেও নেই ১জনও।
তাছাড়াও উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (সেকমো) ৪জন থাকার কথা থাকলেও এদের মধ্যে ১জনও নেই।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) দুইটি প্রশাসনিক পোস্ট। ডেন্টাল সার্জন শুধু দাঁতের চিকিৎসা করেন। অন্যান্য রোগের চিকিৎসা তিনি করেননা। এ তিনজনসহ মোট চিকিৎসক পদ ৪০টি। ওই তিনজন বাদে হাসপাতালে চিকিৎসক আছেন মাত্র ৫ জন।
তাই জরুরী বিভাগে রোগী আসলে হয় আবাসিক মেডিকেল অফিসার না হয় আউটডোর থেকে মেডিকেল অফিসারকে দিয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে হয়।
চিকিৎসক সংকটের সঙ্গে রয়েছে নার্সসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সংকট। মোট নার্স ৩০জনের মধ্যে ২৯ জন আছে। এদের মধ্যে ৩জন ডেপুটেশনে কিশোরগঞ্জ ও ঢাকায় কাজ করেছেন। এছাড়াও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির অনেক কর্মচারীর পদে জনবল সংকট রয়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়ছেন দায়িত্বরত চিকিৎসকসহ রোগীরা। পরিছন্ন কর্মীর অভাবে হাসপাতালের ভিতরে ও বাহিরে প্রায় সময় নোংরা হয়ে থাকে।
যে সকল পদে জনবল আছে তা হলো প্রধান সহকারী-১ জনের মধ্যে ১জন, এম্বুলেন্স ড্রাইভার- ১জনের মধ্যে ১জন এবং পরিসংখ্যান কর্মকর্তা ১জনের মধ্যে ১জন, পরিছন্ন কর্মী ১০ জনের মধ্যে আছে মাত্র ১জন, নাইট গার্ড ২জনের মধ্যে আছে মাত্র ১জন, ওয়ার্ডবয় ৫জনের মধ্যে আছে মাত্র ১জন, আয়া ৫জনের মধ্যে আছে মাত্র ২জন।
এছাড়া টিকেট ক্লার্ক, কার্ডিওগ্রাফার, অফিস সহায়ক, জুনিয়র মেকানিক, সহকারী বাবুর্চি, ওটি এটেনডেন্ট, স্ট্রেচার বেয়ারা ও মালিসহ চিকিৎসা সহযোগী অন্যান্য পদে আরো বেশ কিছু কর্মচারী থাকার কথা থাকলেও এসব পদে একজনও নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হেলথ্ তথ্য অনুযায়ী উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় জনসংখ্যা ২লাখ ২৪ হাজার ১৬০জন মানুষের একটি বড় অংশ চিকিৎসা সেবা প্রত্যাশা করেন ৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তবে দীর্ঘদিন যাবত এই গুরত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে চলছে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবল ও চিকিৎসক সংকট। গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসকের পদ, নার্সসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবল সংকট থাকায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। ফলে ভোগান্তিতে পড়ছেন দায়িত্বরত চিকিৎসকসহ রোগীরা।
এতে উপজেলার দূর-দূরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। সরকারি খরচে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে বেসরকারি ক্লিনিকমুখী হচ্ছেন অনেকেই। উপযুক্ত চিকিৎসক না থাকায় চিকিৎসা সেবা না পেয়ে অনেকেই চলে যাচ্ছেন আশপাশের প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা।
অপর দিকে উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ৬ জন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ২জন। এসব উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র সহ ২১টি কমিউনিটি ক্লিনিকে তীব্র ঔষধ সংকট দেখা দিয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রেসার ও ডায়াবেটিসের ঔষধ না থাকায় রোগীরা ঔষধ না নিয়েই ফিরে যেতে হচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বাড়ছে জনমনে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। পর্যাপ্ত জালানি না থাকায় এম্বুলেন্স ব্যাবহারেও সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে কথা হলে মনোয়ারা (৫০) বলেন, ‘আমার প্রেসার ও ডায়াবেটিস রোগ। ডাক্তার দেখাতে আসছি। ডাক্তার পাচ্ছি না। এমনিতেই অসুস্থ। দাঁড়িয়ে থেকে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ডাক্তার পেলে দেখায়ে বাড়ি চলে যেতে পারতাম’। শুনেছি বর্তমানে এখানে প্রেসার ও ডায়াবেটিসের ঔষধও নাই।
মরিয়ম আক্তার (৪৫) বলেন, ‘আমি কোমার ব্যাথার রোগী। ডাক্তারের অভাবে ভালো কোনো চিকিৎসা পাচ্ছি না। আজকে দেড় ঘণ্টা হলো অপেক্ষা করছি। শুধু আমি না আরও অনেকে অপেক্ষা করছে। ডাক্তার নাই, সেবা পাচ্ছি না। যদি ডাক্তার থাকে সেবা পাই তাহলে সকলের জন্য ভালো হয়।
কুলিয়ারচর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নূরুল মিল্লাত বলেন, কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক ও জনবল সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে, যার কারণে স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এখানকার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকার কারণে রোগীদের ভোগান্তি বাড়ছে এবং গুরুতর রোগীদের কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতাল, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সহ ভাগলপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, কুলিয়ারচর উপজেলার স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির জন্য দ্রুত চিকিৎসক নিয়োগ এবং বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. জিন্নাত সুলতানা বলেন, জনবল সংকটের কারণে আমরা খুবই বিপাকে আছি। এতগুলো পদে লোকবল না থাকায় রোগীর সঠিক সেবা দেওয়া ও ব্যাহত হয়। তারপরও আমরা চিকিৎসা সেবা দিতে সর্বাত্মক কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু কিছু পদে লোক না থাকায় চাইলেও সঠিক সেবা দেওয়া যায় না। তিনি আরও বলেন, নিয়মিত অর্ধ-শতাধিকের বেশি ভর্তি রোগীসহ বহির্বিভাগে ৪৫০ থেকে ৫০০ জনের উপরে রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। কিন্তু চিকিৎসক স্বল্পতার কারণে তাদেরকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। তারপরও চেষ্টা করা হচ্ছে সাধারণ মানুষ যেন চিকিৎসা নিতে এসে ফিরে না যায়।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. তমাল কান্তি মল্লিক বলেন, ৫০ বেডের হাসপাতাল হলেও তার বেশি রোগী থাকে, আউট ডোরে প্রতিদিন ৫শতাধিক রোগী আসে সেবা নিতে । ডাক্তার সংকটের জন্য আমাদের ডিউটি আওয়ারে বেশি সময় দিয়ে চাপের মধ্য দিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আদনান আখতার বলেন, আমাদের হাসপাতাল একটি সয়ংসম্পূর্ণ হাসপাতাল। এ হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার, এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাম, প্যাথলজিসহ সকল বিভাগের কার্যক্রম চলমান। জনবলের সংকট না থাকলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার পত্র পাঠানো হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত শূন্য পদের অনুকূলে কোনো জনবল পাওয়া যায়নি। ডাক্তার ও জনবল সংকট নিয়োগের জন্য বারবার চিঠি দিয়ে যাচ্ছি। নিরসন হলে সাধারণ রোগীদের সেবার মান বাড়বে।
সার্বিক বিষয়ে কিশোরগঞ্জ সিভিল সার্জন ডা.অভিজিত শর্শ্মা বলেন, কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক ও জনবল সংকটের বিষয়টি আমি অবগত আছি। এ ব্যাপারে দ্রুত সমাধানের চেষ্টা চলমান।
জনগণের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এভাবে কুলিয়ারচর উপজেলার জনগণের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে সংকট আরও প্রকট হবে এমনটাই আশঙ্কা করছেন সচেতন মহল।